হাকিমুল ইসলাম কারী তৈয়ব সাহেবের ঐতিহাসিক সাক্ষাৎকার




দীনি মাদরাসাসমূহের ছাত্র শিক্ষক এবং নেসাব সম্পর্কে দারুল উলুম দেওবন্দের দীর্ঘদিনের মুহতামিম হাকিমুল ইসলাম হযরত মাওলানা কারী তৈয়্যব সাহেব [রহিমাহুল্লাহ] এর ঐতিহাসিক সাক্ষাৎকার :
সাক্ষাৎকার গ্রহণ : মুফতী মাহমুদ আশরাফ উসমানী           
শায়খুল হাদীস, জামিয়া দারুল উলুম করাচী
মাসিক আল বালাগের জন্য ১৩৯৪ হিজরী মোতাবেক ১৯৭৪ সালে হযরত হাকিমুল ইসলাম মাওলানা কারী তৈয়্যব (রহ.) একটি সাক্ষাৎকার নিয়েছিলাম সাক্ষাৎকারটি প্রথমবার মাসিক আল বালাগের জমাদিউল উখরা ১৪১৫ হিজরী (নভেম্বর ১৯৯৪ ঈসায়ী) সংখ্যায় প্রকাশিত হয় সাক্ষাৎকারটিতে শিক্ষক শিক্ষার্থিদের উপদেশ গ্রহণের গুরুত্বপূর্ণ পাথেয় রয়েছে বিধায় প্রথম প্রকাশের চুয়াল্লিশ বছর সাক্ষাৎকারটি পূনরায় প্রকাশ করা হচ্ছে অবশ্য সংখ্যায় সাক্ষাৎকারটির অনেক স্থানে টীকা সংযুক্ত করেছি
....মাহমুদ আশরাফ (গুফিরালাহু)
১লা মহররম ১৪৩৯ হিজরী
পূর্ব প্রকাশের মুখবন্ধ
আজ থেকে বিশ বছর আগে। হিজরী সন তখন ১৩৯৪। ইংরেজী ১৯৭৪ ঈসায়ী আমি তখন মদীনা ইউনিভার্সিটিতে অধ্যয়নরত হাকিমুল ইসলাম হযরত মাওলানা কারী মুহাম্মাদ তৈয়্যব সাহেব [রহিমাহুল্লাহ] একবার মদীনায় আগমন করলেন আলহামদুলিল্লাহ! আমি তখন হযরতের সাক্ষাৎ ভালোবাসাপ্রাপ্তির পরম সৌভাগ্য লাভ করি জনাব কারী বশীর আহমাদ সাহেবের মদীনাস্থ বাসভবনে (যা তৎকালীন ভারত-পাকিস্তানের বুযুর্গদের অবস্থানস্থল ছিল সেখানে) তিনি অবস্থান করছিলেন দীনি মাদরাসাসমূহের বর্তমান প্রেক্ষাপট নিয়ে হাকিমুল ইসলামের একটি সাক্ষাৎকার গ্রহণ করি সাক্ষাৎকারটি রেকর্ড থেকে লিপিবদ্ধ করে (পাকিস্তানের জনপ্রিয় পত্রিকা) মাসিক আল বালাগে পাঠানোর ইচ্ছে থাকলেও অজানা কারণে তা আর হয়ে ওঠেনি বিশ বছর পর ক্যাসেটটি পুনরায় হস্তগত হওয়ায় সাক্ষাৎকারটি দ্বিতীয়বার শোনার সুযোগ হয়েছে তখন বর্তমান প্রেক্ষাপটে সাক্ষাৎকারটির তীব্র প্রয়োজনীয়তা অনুভব করেছি
হাকিমুল ইসলাম হযরত মাওলানা কারী মুহাম্মাদ তৈয়্যব (রহ.) ছিলেন দারুল উলুম দেওবন্দের স্বপ্নদ্রষ্টা হুজ্জাতুল ইসলাম হযরত মাওলানা কাসেম নানুতুবী (রহ.) প্রপুত্র এবং হাকিমুল উম্মত হযরত মাওলানা আশরাফ আলী থানবী (রহ.) এরখলিফায়েমুজায শুধু এতটুকুই নয়, এর সাথে তিনি ছিলেন আকাবিরে দেওবন্দের সকলের নয়নতারা এবং তাদের রুচি অভিরুচির বিশ্বস্ত সংরক্ষক একাধারে প্রায় ষাট বছর তিনি দারুল দেওবন্দের মতো শ্রেষ্ঠ বিদ্যাপীঠের সর্বোচ্চ কার্যনির্বাহী (মুহতামি) পদ অলঙ্কৃত করেছেন কাজেই দীনি মাদরাসাসমূহের বিদ্যমান পরিস্থিতি এবং তা থেকে উত্তরণের উপায় সম্পর্কে হযরতের বক্তব্য অত্যন্ত গুরুত্বের দাবী রাখে বিশ বছর পরও সাক্ষাৎকারটির নতুনত্ব, উপকারিতা কার্যকারিতার ক্ষেত্রে কোন পরিবর্তন আসেনি বরং মাদরাসাগুলোর বর্তমান আবহে হাকিমুল ইসলামের সাক্ষাৎকারটির গুরুত্ব বহুগুণ বৃদ্ধি পেয়েছে
সাক্ষাৎকারটি ক্যাসেট থেকে কাগজে স্থানান্তরিত করার সময় লেখনি শৈলী গ্রহণের পরিবর্তে চেষ্টা করেছি হযরতের হুবহু বক্তব্য তুলে ধরতে যাতে তার কথার মর্ম অভিব্যক্তি অপরিবর্তিত থাকে আশা করি সংশ্লিষ্ট মহলে সাক্ষাৎকারটি পূর্ণ মনোযোগে পড়া হবে এর আলোকে শিক্ষক শিক্ষার্থিরা নিজেদের কর্মপন্থা নির্ধারণ করতে সক্ষম হবে আল্লাহই সর্বোত্তম তাওফিকদাতা
বিনয়াবনত : মাহমুদ আশরাফ উসমানী
//১৪১৫ হিজরী
@হযরত ! দীনি মাদরাসাসমূহের বর্তমান অবস্থা কি আপনার কাছে সন্তোষজনক মনে হয়?
@@হাকিমুল ইসলাম : নেসাব সংশ্লিষ্ট বিষয়ে আমি সম্পূর্ণ নিশ্চিন্ত কারণ নেসাব পড়েই বড় বড় আকাবির উলামা তৈরী হয়েছেন দরসে নেযামির নেসাবে শ্রেণিগত পরিবর্তন আগেও হয়েছে এবং ভবিষ্যতেও হতে থাকবে, তবে নেসাবের মৌলিক বিষয় আগেও যা ছিল এখনো সেটিই আছে, তাতে কোনো পরিবর্তন আসতে পারে না যেমন ধরুন, ‘সিহাহ সিত্তা’, উলুমুল কুরআনসহ  বাকি অন্যান্য যত শাস্ত্র আছে এগুলো নেসাবের মৌলিক বিষয় তাতে সময়ের প্রয়োজনে শ্রেণিগত পরিবর্তন হলেও মৌলিক বিষয় আগের মতই রয়েছে কাজেই নেসাব সংশ্লিষ্ট বিষয় সম্পূর্ণ সন্তোষজনক
দ্বিতীয়ত, সত্য কথা হলো- আমাদের পাঠদান পদ্ধতিতে কিছুটা পরিবর্তন এসেছে আমার মতে পাঠদান পদ্ধতিতে এই পরিবর্তন যোগ্যতা তৈরীতে ভালো কোনো প্রভাব ফেলছে না পূর্বকালে শিক্ষকগণ সংক্ষিপ্ত কথায় মূলবক্তব্যটি মূলপাঠে প্রয়োগ করে ছাত্রদের হৃদয়ে এমনভাবে গেঁথে দিতেন যে, ছাত্রদের কিতাব আত্মস্থ হয়ে যেত ছাত্র দরসের পরে কিতাব খুললে পাঠের মূল বক্তব্যটি তার সামনে ভেসে উঠতো কিন্ত বর্তমানে অবস্থা হলো, শিক্ষকগণমূলপাঠবাবিষয়বস্তুকে বাহানা বানিয়ে নাতিদীর্ঘ আলোচনার মাধ্যমে নিজের বিদ্যা জাহির করে ফলে ছাত্রদের যোগ্যতায় ভাটা পড়ে
প্রথমত, শিক্ষকগণের পাঠদান পদ্ধতিরে পরিবর্তনের ফলে ছাত্ররা কম যোগ্যতা নিয়ে বেড় উঠছে দ্বিতীয়ত, সংখ্যাগরিষ্ঠতার নামে গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠা লাভের পর থেকে সাধারণ মানুষ স্বাধীনচেতা হয়েগেছে ছাত্ররাও যেহেতু যুবক-তরুণ, সুতরাং তাদের উপরও এর একটা প্রভাব পড়েছে প্রবীন (বুযুর্গ) দের সাথে সাধারণ মানুষ এবং নবীনদের যে একটা বন্ধন ছিল তা শিথিল হয়েগেছে আর একারণে ছাত্রদেরইলমী শক্তিদূর্বল হয়ে পড়ছে আমার মতে এটিই সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ এবং মৌলিক বিষয় যে, শিক্ষকের সাথে  নবীন এবং ছাত্রদের সম্পর্ক সুদৃঢ় হতে হবে তাদের মাঝে শিষ্টাচার, শ্রদ্ধাবোধ এবং পূর্ণ আস্থা থাকতে হবে বিষয়গুলোতে যত ত্রুটি দেখা দিবে ছাত্রদের যোগ্যতাও  ততই হ্রাস পাবে
সুতরাং বিদ্যমান পরিস্থিতিতে প্রথমত, আখলাকে বিপর্যয় এসেছে এবং পাঠদান পদ্ধতিতে পরিবর্তন আসার কারণে মূল শিক্ষাতে ত্রুটি দেখা দিয়েছে । এর ফলে যোগ্যতায় বিরূপ প্রভাব পড়ছে। তবে নেসাব সংক্রান্ত বিষয় আলহামদুলিল্লাহ সন্তোষজনক । আর মাদরাসমূহের মধ্যে বড় বড় মাদরাসাগুলোর শিক্ষকগণ যোগ্যতাসম্পন্ন আর ছোট মাদরাসাগুলোতে তো যোগ্য অযোগ্য সব ধরেণের শিক্ষকই থাকে।
@বিভিন্ন অঙ্গন থেকে বলা হয়ে থাকে যে, মাদরাসারগুলোর পাঠ্যক্রমে আধুনিক জ্ঞান-বিজ্ঞান অন্তর্ভূক্ত করা প্রয়োজন এ সম্পর্কে হযরতের মন্তব্য কী?
@@হাকিমুল ইসলাম :
বিষয়টি একটি সুনির্দিষ্ট গণ্ডি পর্যন্ত সঠিক এবং ইতোমধ্যে আমরা বিষয়টি কার্যকরও করেছি আধুনিক অনেক জ্ঞান-বিজ্ঞানের কারণে ইসলামী আকিদার উপরে এক প্রকার বিরূপ প্রভাব পড়ছে যদিও এর ভিত্তিটা ভুল বোঝাবুঝির উপর প্রতিষ্ঠিত তথাপি প্রভাব যে পড়ছে সেটা সত্য যেমন: বিজ্ঞানের মৌলিক থিউরী, আধুনিক দর্শন, আধুনিক জ্যোতির্বিদ্যা ইত্যাদি দ্বীনকে ক্ষতিগ্রস্ত করতে মানুষ এসকল শাস্ত্রকে অস্ত্র হিসেবে ব্যবহার করছে অথচ খোদ এসকল বিদ্যাই দ্বীনকে শক্তিশালী করার এক মাধ্যম আমি মনে করি, বিজ্ঞান যত উন্নত হবে ইসলাম ততই শক্তিশালী হবে কারণ বিশ্বাস দর্শনের দিক থেকে ইসলাম যে সকল দাবী ইতোপূর্বে করেছে আজ বিজ্ঞানই সেসব দাবীর দলীল খুঁজে বের করছে সুতরাং দাবী করি আমরা আর তার সপক্ষের প্রমাণ সংগ্রহে ব্যস্ত এমন সব ব্যক্তিরা যারা উক্ত দাবীর অস্বীকারকারকারী আল্লাহ তাআলা তাদের হাত দিয়েই প্রমাণ উদঘাটন করাচ্ছেন কাজেই বিজ্ঞান দ্বীনের পরিপন্থি নয় বরং সহযোগী সমস্যা মূলত অন্যখানে, তাহলো- আমাদের শিক্ষার পরিবেশ নষ্ট কারণ এসকল আধুনিক বিদ্যার যারা শিক্ষক তারাই ভুল দৃষ্টিভঙ্গি এবং অসৎ উদ্দেশ্য লালন করে, ফলে ছাত্রদের উপর উপরোক্ত শাস্ত্রগুলোর বিরূপ প্রভাব পড়ে তবে শিক্ষক ভালো হলে উক্ত শাস্ত্রগুলোই দ্বীন শক্তিশালী করার এক মাধ্যমে পরিণত হবে......নইলে বহুকাল ধরে মাদরাসাগুলোতে দর্শন, জ্যোতির্বিদ্যা, গণিত ইত্যাদি পঠন-পাঠন হওয়া সত্ত্বেও তখন কেন এর বিরূপ প্রভাব পড়েনি? বর্তমানে বিজ্ঞান ইত্যাদি শাস্ত্র কেন ছাত্রদের মাঝে বিরূপ প্রভাব ফেলছে? কারণ, পূর্বকালে এমন সব ব্যক্তি শিক্ষক হতেন যাদের অন্তরের গভীরে দ্বীনের শিকড় প্রোথিত থাকতো ফলে উক্ত শাস্ত্রগুলো ছাত্রদের চিন্তা-চেতনায় বিরূপ প্রভাব ফেলত না কিন্তু বর্তমানে এমন সব ব্যক্তি শিক্ষকতার আসনে সমাসীন যাদের নিজেদের আখলাক-চরিত্র এবং পারিপার্শ্বিক পরিবেশ ভালো নয় ফলে মানুষের মানুষের মাঝে বিরূপ প্রতিক্রিয়া দেখা দেয় মানুষ ভাবে, বিরূপ প্রভাব শাস্ত্রের কারণে অথচ বিরূপ প্রতিক্রিয়া হচ্ছে শিক্ষকের কারণেঅন্যথায় ইসলামে কোনো সঙ্কীর্ণতা নেই ইসলাম তো মুসলমানদেরকে জ্ঞান-বিজ্ঞানের প্রতিটি শাখায় বিচরণের অনুমতি দেয় তবে জ্ঞানের কিছু কিছু শাখা উপকারের পরিবর্তে ক্ষতিকারক হওয়ায় ইসলাম তা আহরণে নিষেধ করে
ইসলামের এক সাধারণ ঘোষণা হলো-
كلمة الحق ضالة الحكيم حيث وجدها فهو احق بها
জ্ঞানের কথা বিজ্ঞজনদের হারানো সম্পদ যেখানেই সন্ধান পাবে কুড়িয়ে নিবে
ইসলামের এজাতীয় বাণী আমাদেরকে শিক্ষা দেয়- সর্বাবস্থায় জ্ঞান অজ্ঞতা থেকে উত্তম তবে যে সকল বিষয় বাস্তবে উপকারী তো নয়ই উল্টো ক্ষতিকর তাকে জ্ঞান বলা অনর্থক কারণ তাতে সময় নষ্ট ছাড়া  কিছুই হয় না
সুতরাং জ্ঞান যে শাস্ত্রেরই হোক মূলত তা খারাপ প্রভাব ফেলে না তবে হ্যাঁ, ছাত্রের উপর শিক্ষকের প্রভাব পড়ে শিক্ষক আচরণ-উচ্চারণে আখলাকে শীলিত, মার্জিত উন্নত হলে ছাত্রের মাঝেও ভালো প্রভাব পড়বে আর শিক্ষক চারিত্রিক মানসিক দিক দিয়ে খারাপ প্রকৃতির হলে তার কাছে কুরআন-হাদীস পড়েও ছাত্রদের মাঝে বিরূপ প্রভাব পড়বে কাজেই, দ্বীনের জন্য সহায়ক কিংবা দ্বীনের উপর উত্থাপিত আপত্তি খণ্ডনের হাতিয়ার হলে মৌলিকভাবে আমি মনে করি আধুনিক জ্ঞান-বিজ্ঞান অবশ্যই শিক্ষা করা উচিৎ
@ হযরত ! একটু আগে ছাত্রদের আখলাক চারিত্রিক অবস্থার কথা বলছেন আমরা তো বুযুর্গদের থেকে শুনে আসছি যে, মাদরাসা এবং খানকা ভিন্ন ভিন্ন কিছু নয় বরং মাদরাসা এবং খানকা একই জিনিস মাদরাসাগুলো তখন ছিল খানকা ছাত্রদেরকে সেখানে পাঠদান করা হতো, পাশাপাশি আখলাকি এবং চারিত্রিক উন্নয়ন উৎকর্ষ সাধিত হতো তাহলে ছাত্রদের বর্তমান অবনতির কারণ কী এবং এর থেকে উত্তরণের উপায় কী?
@@ হাকিমুল ইসলাম : এতে কোনো সন্দেহ নেয়, পূর্বকালে মাদরাসাগুলো ছিল এক একটা খানকা তার ওপর শিক্ষার আবরণ ছিল ফলে ঘোষণা করা হতো না যে, আমরা তাসাউফ বা তরীকত শিখাচ্ছি তবে তখনকার দিনের বুযুর্গদের কর্মপন্থা, আচরণ-উচ্চারণ ও চরিত্র এমন প্রভাবনীয় ছিল যে, তাদের মজলিসে বসলে স্বয়ংক্রিয়ভাবে স্বভাব-চরিত্র সংশোধিত হতো এটি স্পষ্ট যে, বর্তমানে শিক্ষকদের মধ্যে পদস্খলন দিয়েছে, সে পদস্খলের ভিত্তি যেটাই হোক বর্তমান পরিস্থিতি হলো, ব্যাপকভাবে শিক্ষকদের মধ্যেআখলাকের পরিশুদ্ধির প্রতি কোনো মনোযোগ নেই বিশেষত নবীন শিক্ষকদের তো সেদিকে ভ্রুক্ষেপই নেই
@হযরত ! বর্তমানে ছাত্র-শিক্ষকদের মাঝে সম্পর্কের অবনতির কারণেই কি এ সমস্যা সৃষ্টি হয়েছে?
@@হাকিমুল ইসলাম : আমি মনি করি, এর পেছনে মৌলিক কারণ হলো- ফেৎনা বর্তমানে পরিস্থিতি এবং মানসিকতা এতোই অধপতিত যে, একসময় উস্তাদ-ছাত্রের বিশ্বাস, ভালোবাসা এবং মানসিকতার ঐক্য ছিল বর্তমানে তা আর নেই অনেকাংশে পরিস্থিতির কারণে এমনটি হয়েছে উর্দূতে প্রবাদ আছে- ‘লোহা নিজেই কিছু খুইয়েছে আর কিছু খুইয়েছে কামার শিক্ষকদের মধ্যে অনেক অবনতি দেখা দিয়েছে একজন শিক্ষককে যে স্তরের গুণসম্পন্ন হতে হবে নবীন শিক্ষকদের মাঝে তা বিরল কাজেই ছাত্রদের মাঝে শিক্ষকের অবনতির প্রভাব পড়াটা অবশ্যম্ভাবী নবীন শিক্ষকরাও কিছুকাল পরেই প্রবীন হলে তখন চারিত্রিকভাবে উন্নত স্তরে পৌঁছে যাবেন এটা সত্য কিন্তু বর্তমানে একজন নবীন শিক্ষকের শিক্ষকতার প্রাথমিককাল এমন প্রভাবনীয় নয় যেমনটা ছিল তার শিক্ষকদের শিক্ষকতার প্রাথমিককাল
আমরা যখন ছাত্র ছিলাম তখনকার উস্তাদগণ ইলম-তাকওয়া-আখলাক সার্বিক দিক দিয়ে আদর্শ মানের ছিলেন হযরত শাহ সাহেব (মাওলানা আনওয়ার শাহ কাশ্মিরী) রহিমাহুল্লাহর মাঝে সুন্নাহ অনুকরণের স্পৃহা এতো প্রবল ছিল যে, আমরা তার চাল চলন দেখে মাসআলা জেনে নিতাম আর মাসআলা যা খুঁজে পেতাম তা হতো হুবহু হযরত শাহ সাহেবের আমলের ন্যায় ছিলেন নিশ্ছিঁদ্র মনোযোগী । সন্দেহ নেই তিনি যে সারাক্ষণ আখেরাতের ভাবনায় ডুবে থাকতেন
হযরত মাওলানা মুফতী আজিজুর রহমান সাহেব দুপুরে ছোট মসজিদএসে কাইলুলাকরতেন । সাধারণত তিনি পা গুটিয়ে শুতেন । কখনো পা ছড়িয়ে ঘুমাতেন না । আমার শ্বশুর মরহুম মৌলভী মাহমুদ সাহেব রামপুরী পড়ালেখাকালে মুফতী আজিজুর রহমান সাহেবের সাথে দেওবন্দের ছোট মসজিদে থাকতেন । প্রথমদিকে তিনি ভাবতেন, এটি হয়তো হযরত মুফতী সাহেবের সাময়িক আমল কিন্তু যখন দেখলেন, এটি তার অভ্যাসগত আমল তখন একদিন মুফতী সাহেবকে জিজ্ঞেস করলেন: আপনি পা ছড়িয়ে কেন ঘুমান না? বললেন: ভাই! পা ছড়িয়ে ঘুমানোর জায়গা কবর; দুনিয়া নয় ...... থেকে স্পষ্ট প্রতীয়মান হয় যে, সারাক্ষণ তার মাঝে আখেরাতের ভাবনা জাগ্রত থাকত
হযরত মুফতী সাহেবেরই আরেকটি ঘটনা আমরা তার কাছে তাফসীরে জালালাইন পড়েছি পাঠদানকালে আলোচনা আসল ليس للانسان الا ما سعى অর্থ : মানুষ যা আমল করবে কেবল তারই প্রতিদান পাবে আয়াত নিয়ে একদিকে আয়াতের দাবী একজনের আমল অন্যজনকে উপকৃত করে না অপরদিকে বিভিন্ন হাদীস থেকে স্পষ্ট সাব্যস্ত হয় ঈসালে ছাওয়াবের প্রামাণ্যতা সুতরাং বাহ্যত আয়াত হাদীসের মাঝে বৈপরিত্য দেখা যাচ্ছে
আয়াতের আলোচনা হযরত মুফতী সাহেব আমাদেরকে ইতিবাচক পন্থায় বিষয়টি বুঝিয়ে দিলেন পরিশেষে বললেন, তথাপি বিষয়টি আমার কাছে এখনো পুরোপুরি পরিস্কার হয়নি অনেক কিতাব ঘেটেছি, কিন্তু প্রশান্তিদায়ক কোনো উত্তর খুঁজে পাইনি ঘরে ফিরলাম গ্রীষ্মের রাতে চৌকিতে শুয়েছিলাম তখন অন্তরে উদয় হলো, কুরআনের একটি সন্দেহ নিয়ে যদি তোমার মৃত্যু হয় তবে ঈমানের পরিণতি কী হবে? মনে এতটুকু খটকা আসতেই গঙ্গুহের উদ্দেশে পায়ে হেঁটে রওনা হলেন
উপরোক্ত ঘটনায় হযরত মুফতী সাহেবের আখেরাতের ভাবনা সুস্পষ্ট বিষয়টিকে তিনি স্রেফ গবেষণার দৃষ্টিতে দেখেননি, বরং আখেরাতের দৃষ্টিতে দেখেছেন কুরআনের আয়াতে সন্দেহ মানে ঈমানে সন্দেহ, আর সন্দেহযুক্ত ঈমানের স্থায়িত্ব কঠিন চেতনা থেকেই তার গঙ্গুহের পথে যাত্রা পায়ে হেঁটে চলতে অভ্যস্ত না হয়েও সারা রাত্র হেঁটে গাঙ্গুহ পৌঁছলেন ফজরের সময় গাঙ্গুহ পৌঁছলেন হযরত রশিদ আহমাদ গাঙ্গুহী (রহ.) তখন ওযু করছিলেন হযরত মুফতী সাহেব সালাম দিলেন হযরত গাঙ্গুহী সালামের উত্তর দিয়ে জিজ্ঞেস করলেন-কে?
হযরত ! আযিযুর রহমান
কিন্তু সময়ে ! তুমি কি রাতে এসেছ?
রাতভর সফর করে এক্ষুণি পৌঁছলাম
এমন কী প্রয়োজন ছিল যেজন্য রাতভর সফর করতে হলো
হযরত ! কুরআনে এসেছে- একজনের চেষ্টা অন্যজনের কাজে আসবে না ওদিকে হাদীসে বর্ণিত হয়েছে- ঈসালে ছাওয়াব করলে একজনের চেষ্টা অন্যজনের উপকারে আসবে, আয়াত হাদিসের বাহ্যিক বৈপরিত্য কোনোভাবেই সমাধান হচ্ছে না - মাওলানা আযিযুর রহমান সাহেবে দাঁড়িয়ে মনের খঁটকা পেশ করলেন
হযরত গাঙ্গুহী (রহ.) ওযুর স্থানে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে বললেন, لَيْسَ لِلْإِنْسَانِ إِلَّا مَا سَعَى আয়াতে চেষ্টা দ্বারা ঈমানের চেষ্টা উদ্দেশ্য অর্থাৎ একজনের ঈমানে আরেকজনের নাজাতের অবলম্বন হতে পারবে না তবে একজনের আমল অন্যজনের কাজে আসবে না, এখানে তা উদ্দেশ্য নয় সুতরাং হাদীস প্রমাণ করে, একজনের নেকআমল অন্যজনের কাজে আসবে আর কুরআন বলে, একজনের ঈমান আরেকজনের কোনো কাজে আসবে না কাজেই এতদুভয়ের মাঝে কোনো বিরোধ নেই
মুফতী আযিযুর রহমান সাহেব বলেন, হযরত গাঙ্গুহী বলছিলেন আর আমি দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে শুনছিলাম মনে হচ্ছিল, আমার সম্মুখে এক জ্ঞানসমুদ্র বয়ে চলেছে আমাদের পূর্বসুরীদের এক একটি কথায় গভীর জ্ঞান ছিল
হযরত নানুতুবী (রহ.) কে কেউ জিজ্ঞেস করল, হযরত! হাদীসে বিদআতের নিষেধাজ্ঞায় বলা হয়েছে, من أحدث في امرنا هذا ما ليس منه فهو رد দ্বীনের অন্তুর্ভূক্ত নয় এমন কোনো বিষয় যে ব্যক্তি দ্বীনের অন্তর্ভূক্ত করবে তা প্রত্যাখ্যত হবে তাহলে উক্ত হাদীসমতে মাদরাসাগুলোও তো পরিত্যাগযোগ্য ! ইসলামের প্রথমযুগে বর্তমান মাদরাসাগুলোর অস্তিত্ব কোথায় ছিল? মাদরাসার বর্তমান নিয়মের ক্লাস এবং ঘণ্টা বাজানোর নিয়ম কোত্থেকে এসেছে? সুতরাং এসব কিছু বিদআত নবআবিস্কৃত, কাজেই তা নিষিদ্ধ হওয়া কর্তব্য
হযরত নানুতুবী (রহ.) সংক্ষিপ্ত ভাষায় উত্তর দিলেন, হাদীসে احداث في الدين তথা দ্বীনের মধ্যে নতুন কোনো সংযুক্তির ব্যাপারে নিষেধাজ্ঞা এসেছে, তবে احداث للدين তথা দ্বীনের জন্য নতুন কিছু বিষয় আবিস্কার নিষিদ্ধ করা হয়নি
হযরত নানুতুবী (রহ.) দুশব্দে বিষয়টির গ্রন্থি উন্মোচন করলেন অর্থাৎ, দ্বীনের শক্তিবৃদ্ধি, সমৃদ্ধি এবং সাহায্যের জন্য কোনো উপায় অবলম্বন স্বয়ং দ্বীনের মধ্যে সংযুক্তি নয় মাদরাসাগুলোতে সকাল-সন্ধ্যা ঘণ্টা বাজানোর নিয়ম চালু আছে, তার মানে এই নয় যে, সংশ্লিষ্টরা এটাকে দ্বীন মনে করে করছে যে উদাহরণত, চার ঘণ্টাই হতে হবে এর বেশি হতে পারবে না যাহোক, দ্বীনের মধ্যে নবআবিস্কার এবং দ্বীনের জন্য নবআবিস্কার দুটি বিষয়ের পারস্পরিক পার্থক্যের মাধ্যমে নানুতুবী (রহ.) সমস্ত সংশয় দুর করে দিলেন
প্রেক্ষিতে একটি ঘটনা মনে পড়লো মাওলানা শাহ ইসমাঈল শহীদ (রহ.) এর জীবদ্দশায় এক আরব হিন্দুস্তান আগমন করল ভারতবর্ষে তখন আরবদের আনাগোনা একদম বন্ধ ছিল কখনো কোনো আরব আগমন করলে সবাই চিলের মত তার পিছে পিছে ঘুরত সম্ভাব্য সকল উপায়ে তাকে খাতির তোয়াজ করত আরবীয় লোকটি ছিল শাফেঈ এক মসজিদে তার সালাত আদায়ের সুযোগ হয় যেখানে সব মুসল্লীই ছিল সাধারণ মুসলমান । শাফেঈদের ন্যায় তিনিও সালাতে রাফয়ে ইদাইন করলেন । অশিক্ষিত সাধারণ মুসলিমরা ভাবল, কোন বদদীন হবে হয়ত, সালাত আদায় করতে জানে । সালাত আদায়ান্তে হৈ চৈ শুরু হল । কেউ কেউ তো আরবীর উপর হাত তুলে বসল । মারপিট করল । যাহোক এদেশে তিনি একজন মেহমান । মাওলানা ইসমাঈল শহীদ (রহ.) সংবাদ পেয়ে খুবই রাগ করলেন । ক্ষিপ্ত হয়ে বললেন, মেহমানকে তো সম্মান করতেই হবে সেখানে যদি হন আরবীয় মেহমান তবে তো সম্মান করা আবশ্যক । আদেশ জারি করলেন, আজ থেকে আমাদের সব মসজিদে রাফয়ে ইদাইন করা হবে । ‘রাফয়ে ইদাইন পরিত্যাগ’ পরিহার করা হবে । সব মসজিদে রাফয়ে ইদাইন চালু হল । কয়েকদিন অতিবাহিত হতেই দেখা গেল কোথায় রাফয়ে ইদাইন কোথাও রাফয়ে ইদাইন বর্জন । (হেসে বললেন) এক অদ্ভুত হযবরল অবস্থার সৃষ্টি হল । প্রকৃত অর্থে রাফয়ে ইদাইনের সূচনা হল । কেবল সালাতেই নয় বরং মারামারিতেও রাফয়ে ইদাইন হচ্ছিল । সারকথা এ নিয়ে অনেক ফেৎনা হল । লোকজন হযরত শাহ আব্দুল আযীয দেহলবী (রহ.) কাছে গেলেন । হযরত ! আপনার ভাতিজা বিরাট ফেৎনার সৃষ্টি করেছে । সব মসজিদের রাফয়ে ইদাইন চালুর হুকুম জারি করেছে । অনেক বড় সংকট তৈরী হয়েছে এবং এ ফিৎনা সব দিকে ছড়িয়ে পড়ছে । আপনি তাকে বুঝান ।
শাহ সাহেব বললেন, ভাই! ইসমাঈলের বুদ্ধিদীপ্ততা ও মেধার প্রখরতা আপনারা ভালো করেই জানেন । তাকে বশ করা আমার দ্বারা সম্ভব হবে না । সে অত্যন্ত মেধাবী এবং প্রতিভাবান । আমি একটি বললে সে বিশটি কারণ দর্শিয়ে আমাকেই নির্বাক করে দিবে । তখন কী সমাধান হবে । সমাধানের একটিই উপায়, বংশের ছোট বড় সবাই শাহ আব্দুল কাদির সাহেবকে শ্রদ্ধা করে । অথচ তিনি ছিলেন বয়সে ভাইদের সবার ছোট । তবুও তাকওয়া ও চারিত্রিক শুভ্রতার দরুণ বড় ভাইও তাকে শ্রদ্ধা করত । তিনি আকবরী মসজিদে চল্লিশ বছর এতেকাফ করেছেন । এতেকাফকালে কুরআন তেলাওয়াত ছাড়া দ্বিতীয় কোনো ব্যস্ততা ছিল না । তার ইন্তেকালের দিন শাহ আব্দুল আযীয দেহলবী (রহ.) এর কাশফ হয় যে, শাহ আব্দুল কাদির (রহ.) এর আগমনে তার সম্মানার্থে আজ দিল্লীর সমস্ত কবরস্থান থেকে আজাব রহিত করা হয়েছে । মাওলানা শাহ আব্দুল কাদির (রহ.) ছিলেন এমনই উচ্চস্তরের এক আল্লাহওয়ালা বুযুর্গ ।
লোকজন শাহ আব্দুল কাদির সাহেবের কাছে গিয়ে বললেন, আপনার ভাতিজা ফিৎনা সৃষ্টি করেছে । শাহ সাহেব বললেন, ডাকো ইসমাঈলকে ! মাওলানা ইসমাঈল শহীদ হাযির হলেন । জিজ্ঞেস করলেন, মিয়া ইসমাঈল ! তুমি কি রফয়ে ইদাইন করতে হুকুম জারি করেছ? জ্বী, হযরত । কেন? শাহ সাহেব জিজ্ঞেস করলেন । ইসমাঈল শহীদ (রহ.) বললেন, হযরত ! রফয়ে ইদাইনের সুন্নাহটি এমনই মৃতপ্রায় হয়ে গিয়েছিল যে কেউ তার উপর আমল করলে তাকে মারপিট করা হচ্ছে । আর হাদীসে বর্ণিত হয়েছে-  من أحيا سنتى عبد فساد أمتى فله أجر مائة شهيد (যে ব্যক্তি আমার উম্মতের ফেৎনার সময় আমার সুন্নাহকে যিন্দা করবে সে এক শ’ শহীদের ছাওয়াব পাবে । ) কাজেই আমি একটি সুন্নাহ যিন্দা করেছি । কারণ সুন্নাহটি এমনই মৃতপ্রায় হয়েছিল যে তার উপর আমলের দরুণ মারপিট করা হচ্ছিল । সুতরাং সুন্নাহটি প্রচলনের উদ্দেশে আমি রাফয়ে ইদাইনের আদেশ জারি করেছি ।...শাহ সাহেব বললেন, মিয়া ইসমাঈল ! আমরা তো মনে করতাম তুমি বুঝে শুনে হাদীস অধ্যয়ন করেছ । তোমার তো দেখছি হাদীসের বুৎপত্তির ছোঁয়াও লাগেনি । সুন্নাহ যিন্দা করার কী অর্থ? সুন্নাহ যিন্দা করার অর্থ হল,  সুন্নাহ মূলোৎপাটিত হয়ে বিদআহ তার স্থান দখল করেছে এমন ক্ষেত্রে সু্ন্নাহ যিন্দা করা এক শ’ শহীদের ছাওয়াবের সমতুল্য । এখানে তো একটি সুন্নাতের বিপরীতে আরেকটি সুন্নাত বিদ্যমান । রাফয়ে ইদাইন যদি সুন্নাহ হয়ে থাকে তবে রাফয়ে ইদাইন পরিত্যাগ করাও সুন্নাহ । এক ইমাম একটি সুন্নাহ গ্রহণ করেছেন অন্যজন অপরটি, এখানে সুন্নাহ যিন্দা করার সুযোগ কোথায়? সুন্নাহ বিলুপ্ত হয়ে গেছে এবং বিদআহ সুন্নাহের স্থান দখল সেখানে সুন্নাহ জীবন্ত করতে হবে কিন্তু এখানে এমন কোন বিদআহ আছে?....মাওলানা ইসমাঈল শহীদ (রহ.) বললেন, হযরত! আমার ভুল হয়ে গেছে । অতঃপর তিনি মসজিদে মসজিদে নিজে ঘুরে ঘুরে ঘোষণা করলেন, আমার ভুল হয়েছে । সবাই আগের মত রাফয়ে ইদাইন ছাড়াই সালাত আদায় করবেন ।
কথাগুলো এ প্রসঙ্গে মনে পড়ল যে, আমাদের আকাবিরগণ লম্বা চওড়া তাকরীর করতেন না । তাদের এক একটি বাক্যে মাসআলা সমাধান হয়ে যেত । এটা তখনই সম্ভব যখন যোগ্যতা হবে অত্যন্ত শক্তিশালী  এবং ইলমের প্রতি থাকবে নিশ্ছিদ্র নিমগ্নতা । আজ তো ইলমের জন্য সাধনা নেই উপরন্তু মেধাও আগের দিনের মানুষের মত শক্তিশালী নয় এবং ইলমের প্রতি নিশ্ছিদ্র নিমগ্নতাও নেই । কিতাবে যা মুতলায়া করেছে সকালে দরসে সেটিই বলছে, এটাকে বর্ণনা বলা গেলেও দরস বলা যায় না । কেননা তাতে অন্তরে সে ভাবাবেগের সৃষ্টি হয় না । যেকারণে আজ ছাত্রদের যোগ্যতায় ত্রুটি হচ্ছে । সুতরাং সমস্যা নেসাব কিংবা অন্যকোনো জায়গাতে নয় বরং যা কিছু ত্রুটি তা পাঠদান পদ্ধতি এবং শিক্ষকদের অনুন্নয়নে । শিক্ষকগণ শিক্ষকতাকে পেশা জ্ঞান করে কেবল পড়ানোর জন্য মুতালায়া করে । ছাত্রদের যোগ্যতা না হওয়ার পেছনে এটাও একটি সমস্যা ।
অপরদিকে গণতন্ত্রের নামে দেশের নানাবিধ পরিস্থিতি ছাত্রদের একাগ্রতা জ্ঞানমগ্নতা নষ্ট করে ফেলেছে । প্রতিটি ছাত্রেরই চিন্তা থাকে সংগঠন কিংবা রাজনীতিতে সামান্য হলেও যুক্ত হওয়া । অথচ ইমাম আবু ইউসুফ (রহ.) বলেছেন- العلم لا يعطيك بعضه حتى تعطيه كلك ইলমের জন্য সর্বস্ব ত্যাগ না করলে যৎসামান্য ইলমও পাবে না । সেখানে ইলমের জন্য সামান্য ত্যাগ স্বীকার করে পূর্ণ ফল আশা করা কেমন? তালেবুল ইলম কখনো এদিকে কখনো ওদিকে আবার কখনো জীবিকাসহ নানান চিন্তায় বিভোর থাকে, এর মধ্যে যৎসামান্য সময়ে ইলমের প্রতি মনোযোগী হলে যোগ্যতা তৈরী হবে কিভাবে?
এজন্যই আলোচনার সূচনাতে আমি বলেছিলাম, ‘কিছু ক্ষয় করেছে লোহা কিছু করেছে কামার’ । কিছু শিক্ষক আছেন তারা সামনে অগ্রসর হতে চান না । কিছু তালেবুল ইলম আছে যাদের পরিশ্রম ত্রুটিপূর্ণ । অথচ শেষমেষ সব দোষ গিয়ে চাপে নেসাবের ওপরে ।
আমাদের শ্রদ্ধেয় উস্তায হযরত মাওলানা মুহাম্মাদ ইবরাহিম ছিলেন খুবই মিতআলাপী । কেউ তাকে বলল, হযরত ! নেসাবে কিছু পরিবর্তন প্রয়োজন । তিনি তার চিরাচরিত অভ্যাসমত লম্বা চওড়া এক ‘হ্যাঁ’ করে বললেন, দেখ ! শিক্ষার ক্ষেত্রে প্রধানতম বস্তু তিনটি : শিক্ষক, ছাত্র এবং তৃতীয়ত নেসাব । শিক্ষকগণ হলেন আমাদের বড়রা । হাতে ছুরি, কেউ কোনো মন্তব্য করা মাত্রই ঘাতক আখ্যা পাবে । আর এ সময়ের ছাত্রদের কথা কী বলব, তাদের কলিজাটা বাঘের মত । কেউ তাদেরকে সমালোচনার লক্ষ্য বানালে তারা এসে জাপটে ধরবে । মানুষ ভয় । ব্যাস, সব চাপ এখন গিয়ে পড়েছে ভাষাহীন নেসাবের ওপরে । সুতরাং যে যার মতো সমালোচনা করছে, নেসাবের এই সমস্যা সেই সমস্যা ।[1]
ত্রুটি থাকলে ছাত্র এবং শিক্ষকের মাঝে, নেসাবে ত্রুটি নেই । কিন্ত নেসাব তো নির্বাক । তার উপর সবার পর্যবেক্ষণি দৃষ্টি । এই ছিল বুনিয়াদী সমস্য । যাহোক মাদরাসা শিক্ষায় কিছু আধুনিক জ্ঞান-বিজ্ঞান অন্তর্ভূক্তি প্রয়োজন যাতে আমাদের তালেবুল ইলমরা এ সম্পর্কে অজ্ঞ না থাকে ।
@....হযরত ! বর্তমানে ফারেগীনদের মাঝে আগের মত দ্বীনি কাজের আগ্রহ দেখা যায় না । বাতিলের বিরুদ্ধে লড়াই, স্বনির্ভরতা এবং নিজ থেকে অগ্রসর হয়ে দ্বীনি কাজ করার মানসিকতা আগের মত এখন চোখে পড়ে না । এর কারণ কী?
@@ হাকীমুল ইসলাম : প্রথমত, হাদীসে বর্ণিত হয়েছে যে, الناس كابل مائة لا تكاد تجد فيها راحلة এক শ’ উটের একটি কাফেলা । সবার দাঁত আছে । কিন্ত বাহনের উপযোগী কেবল একটি । কাজেই, পঞ্চাশ হাজার তালেবুল ইলমের মধ্য থেকে একজনও যোগ্য নেই এমনটি অসম্ভব । তবে শকরার দু’ একজন অযোগ্য বের হলে তা না থাকার নামান্তর । এখন এমন সব ছাত্র বের হচ্ছে যারা আপন আপন যোগ্যতা অনুপাতে কাজ করছে । কিন্ত আমাদের সামনে ৯৯ ভাগ অযোগ্য ও কাজের অনুপোযুক্ত হওয়ার কারণে যোগ্যদের মূল্যায়ন নেই । তার মানে কেউ যে যোগ্য নেই তা কিন্ত নয় । যোগ্য আলেম যদি না থাকবে তবে বর্তমানে দ্বীনের কাজ কিভাব চলছে? বহস, মুনাযারা, বাতিলের মোকাবেলা সবই তো হচ্ছে । মানুষ দ্বীনের কাজ করছে । তরুণরাও কাজ করছে । তবে তাদের সংখ্যা হাতে গোণা কতিপয় ।
স্বেচ্ছায় অগ্রসর হয়ে দ্বীনি কাজ করার চেতনা বিলুপ্তির পেছনে একটি মৌলিক কারণ হলো, অর্থনৈতিক দৈন্যতার দরুণ শিক্ষাজীবনে চিন্তা জগতে বিরাজ করতে থাকে, দ্রুত পড়ালেখার পাঠ চুকাতে হবে যাতে পরিবারকে স্বচ্ছল করা যায় । বাবা দুর্বল হয়েগেছে, মা ইন্তেকাল করেছে, অমুক অমুকও দুনিয়া থেকে বিদায় নিয়েছেন, দু’ চার পয়সা উপার্জন করতে পারলে সন্তানাদির দু’ মুখ আহারের ব্যবস্থা হবে । ছাত্রজীবনের যাদের চিন্তা চেতনা এমন হয় তারা ইলম অর্জনে কিভাবে উন্নতি করবে? বর্তমানে প্রায় ছাত্রের এই দশা ।
দ্বিতীয়ত, উন্নত চিন্তাচেতনা লালনকারী তালেবুল ইলম মাদরাসাগুলোতে খুব কম আসে । মাদরাসায় আগত ছাত্রদের অধিকাংশের চিন্তা চেতনা অনুন্নত । তারা দেখে, রুটি রিযিক তো মাদরাসার অঙ্গনেও পাওয়া যায় । আট নয় বছর পড়ালেখা করে এ শিক্ষার মাধ্যমেও কিছু উপার্জন করা সম্ভব । তারা বছরের পর বছর পার করে নেসাব পাড়ি দেয় ঠিক কিন্ত মেধার সীমানা যদ্দুর তার বাইরে তো যেতে পারে না । ফলে চিন্তা চেতনার দৈন্যতার কারণে তাদের ইলমও দুর্দশাগ্রস্ত হয়ে পড়ে ।
‘ফারুকে আজম’ [রাদিয়াল্লাহু আনহু] একদা বলেন, আমি কি বলে দেব ইলম কখন দুর্দশাগ্রস্ত হয়ে পড়বে? বলা হল, জ্বী বলুন । হযরত উমর [রাদিয়াল্লাহু আনহু] বললেন, নিম্নশ্রেণির মানুষ যখন ইলম অর্জন করতে শুরু করবে । যারা নিজেরাও নিম্নপ্রকৃতির তাদের চিন্তা চেতনাও নিম্নপ্রকৃতির । তারা যখন আমলের প্রতি মনোযোগী হবে তখন তাদের নিচুতা তাদের ইলমে স্পষ্ট হয়ে উঠবে । তখন তাদের ইলমও নিম্নমানের রূপে দৃষ্টিগোচর হবে । অন্যথায় উন্নত চিন্তা চেতনার অধিকারী এবং উচ্চ শ্রেণির মানুষ যদি ইলম অর্জন করে তবে আজও আগের মতো দ্বীনী কাজ করা সম্ভব হবে ।
@...হযরত ! উন্নত চিন্তাশীল এবং অভিজাত শ্রেণির মানুষ তাদের সন্তানদেরকে মাদরাসায় ভর্তি করে না । তাদেরকে মাদরাসামুখি করার কী উপায়?
@@...কথা হল, আগে আখেরাতের চিন্তা ছিল জয়জয়কার আর আজ দুনিয়াদারীর জয়জয়কর । উন্নত চিন্তাশীলরা কিভাবে রাষ্ট্রীয় পদ, চাকরী পাবে তারা সে চিন্তায় বিভোর । দ্বীনি ইলমের অঙ্গনে তাদের আগমন কম । এখানে এমন সব লোক আসে যাদের অভিজাতদের মত যোগ্যতা নেই । তাদের ভাবনা, চল দ্বীনের যোগ্যতা অর্জন করি । মাদরাসা তো দ্বীনের কেন্দ্র । যারাই আসবে আমরা তাদের শিখাব । চাই তারা যে কোনো স্তরের হোক । কিন্ত আমাদের আকাবিরদের নিয়ম ছিল, ইলমের প্রতি শিক্ষার্থীর আগ্রহ কেমন প্রথমে তা যাচাই করতেন । যার যে বিষয়ের প্রতিভা থাকত তাকে সে বিষয়ে ভর্তি নিতেন । সহজাত প্রতিভার দরুন সে উক্ত বিষয়ে দক্ষতা অর্জন করত ।
আমি যখন আফগানিস্তান যাই সেখানে তখন শিক্ষমন্ত্রী ছিলেন সরদার নাঈম । তিনি আমার কাছে অভিযোগ করে বলেন, জনাব ! আমরা এই করেছি সেই করেছি কিন্ত আমাদের কোনো আশাই পূর্ণ হয়নি । আমি বললাম, জনাব ! কী সেই আশা? তিনি বললেন, আমরা কোনো আলেমকে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী পররাষ্ট্রমন্ত্রী বানাতে । কিন্ত দেখি এমন কোনো উপযুক্ত আলেম পাইনা । আমি বললাম, আপনার প্রশ্নের উত্তর দেওয়ার পূর্বে একটি কথা বলতে চাই, তাহল আপনাদের সে আশা কখনো পূর্ণ হবে না ।....আমি উত্তরের ক্ষেত্রে ভিন্ন পথ ধরলাম । নইলে সোজা সাপ্টা ছিল এই যে, আজকাল রাজনীতি তো ভিন্ন একটি বিষয় । যারা রাজনৈতিক বিষয়ে বিশেষজ্ঞ হবে তারা এ পদের উপযুক্ত হবে । কেউ ফকীহ ও মুহাদ্দিস হওয়া সত্ত্বেও রাজনীতির মারপ্যাচ সম্পর্কে অবগত না হয় তবে সে তো এ পদের যোগ্য হতে পারে না । কিন্ত আমি তাকে এ উত্তর দেইনি । ....আমি বললাম, আপনার সে আশা কখনো পূর্ণ হবে না । কেন? বললাম, কারণ আফগানিস্তান থেকে আপনারা যে ধরণের ছাত্র দেওবন্দে পড়তে পাঠান না জানি কোন জঙ্গল থেকে ধরে তাদেরকে প্রেরণ করেন । মোটা মাথার এ সকল তালেবুল ইলমের মানসিকতা বদলাতে প্রয়োজন দশ বছর । অত:পর তাদের পড়ানোর জন্য প্রয়োজন আরো দশ বছর । আপনারা যদি মন্ত্রিপরিবার, শাহী খান্দান এবং অভিজাত বংশীয়দেরকে পাঠাতেন তখন আমরা আপনাদেরকে দেখাতাম, ইলম কাকে বলে? আপনারা যদি জঙ্গল থেকে জংলী এবং পাহাড়ী মার্কা লোক প্রেরণ করেন তবে তাদের ওপর ইলমের কী প্রভাব পড়বে? তখন আফগানিস্তানের প্রধান আলেম বলে উঠলেন ‘মাওলানা হক মি ফরমায়েদ, হক মি ফরমায়েদ ।’
অতঃপর আমি বললাম, দৃষ্টান্ত স্বরূপ উল্লেখ করতে চাই, আপনাদের দৃষ্টিতে মুফতী কেফায়াতুল্লাহ সাহেব কেমন ব্যক্তি? বলল, অত্যন্ত দূরদর্শী ব্যক্তি, ভারতবর্ষে তিনি এই এই উল্লেখযোগ্য অবদান রেখেছেন । আমি বললাম, তিনি দারুল উলুম দেওবন্দের ছাত্র, পৃথিবীর কোনো  ইউনিভার্সিটির গ্রাজুয়েট ছিলেন না । আমি আবারও প্রশ্ন করলাম, মাওলানা হুসাইন আহমাদ মাদানী কেমন? বলল, সুবহানাল্লাহ ! খুব উচু মাপের মানুষ তিনি । বললাম, তিনি দারুল উলুম দেওবন্দের সন্তান । কোনো বিশ্ববিদ্যালয়ের গ্রাজুয়েট নন । ....মাওলানা শাব্বীর আহমাদ উসমানী; যিনি পাকিস্তান চলে গিয়েছিলেন তিনি? বলল, অত্যন্ত দূরদর্শী ছিলেন তিনি । বললাম, তিনিও কোনো বিশ্ববিদ্যালয়ের গ্রাজুয়েট ছিলেন না ।
এভাবে দশ থেকে বিশ জন ব্যক্তির নাম উল্লেখ করে আমি বললাম, প্রকৃতিগতভাবে তারা ছিলেন উন্নত চিন্তাশীল । ইলম তাদের উন্নত চিন্তা চেতনাকে আরো উন্নততর করে দিয়েছে । ইলম নতুন কিছু সৃষ্টি করে না বরং সৃষ্ট বস্তকে বিকশিত করে ।[2]
...কারো মধ্যে যদি কেবল নিচুতাই থাকে তবে ইলম সেটাই প্রকাশ করবে, আর সুকুমারবৃত্তি থাকলে ইলম তাই বিকশিত করবে । ইলম নতুন কিছু সৃষ্টি করে না । প্রধান আলেম বললেন, একদম বাস্তব । আমরা প্রতিশ্রুতি দিচ্ছি আমরা প্রতি বছর মন্ত্রি এবং শাহী খান্দান থেকে এগারো জন ছাত্র প্রেরণ করব । আমি বললাম, তাহলে আমরাও দেখাবে তাদের মাঝে কী গুণের উন্মোষ ঘটে?
কিন্ত ঠিক এ মুহূর্তে আমার মাথায় একটি চিন্তার উদয় হল । শাহী বংশ থেকে আগত ছাত্রদের খাদেমগিরি কে করবে? তাদের সভ্যতা সংস্কৃতি ভিন্ন । এখানে দরিদ্র ছাত্রদের বসবাস । সুতরাং তাদের মেহমানদারির জন্য বহু অর্থের প্রয়োজন । কারণ বাদশাহর ছেলে কেউ মন্ত্রির ছেলে...।
এ ভাবনা থেকে আমি তাদেরকে বললাম, আমরা তাদেরকে আমাদের খরচে পড়ালেখা করাব? বলল, না না, আপনাদের খরচ বহনের প্রয়োজন নেই সব খরচ সরকারই বহন করবে । আমি মনে মনে বললাম, আমার আর কী প্রয়োজন ? এজন্যই আমি বলেছিলাম.......। এরপর আমি বললাম, অত্যন্ত ফলপ্রসু চিন্তা । আমরা তাদেরকে পড়াব । তবে আমাদের আরেকটি প্রস্তাব আছে, আমরাও এগারো জন ছাত্র প্রতিবছর আপনাদের দেশে পাঠাব । কারণ আপনাদের এখানে বিভিন্ন ভাষার ভিন্ন  ভিন্ন কলেজ রয়েছে । আফগানিস্তানের নাজাত কলেজ এখানে বিশুদ্ধ জার্মান ভাষা শিখান হয় । এস্তেকলাল কলেজে ফরাসী ভাষা, কাকুল পয়তাব কলেজে তুর্কী ভাষা শিখান হয় । এ ছাড়াও ইংরেজী ভাষা শিক্ষার জন্য রয়েছে ভিন্ন ভিন্ন কলেজ ।
আমরা চাই, মাদরাসায় ছাত্ররা পড়ালেখা করে দ্বীনের প্রচারক হয়ে বহিঃরাষ্ট্রে গমন করতে ভাষা শিক্ষা প্রয়োজন । আপনাদের এখানে ভাষা বিষয়ক কলেজ রয়েছে কাজেই আপনারা পাঠাবেন এগারো জন এবং আমরা আপনাদের কাছে এগারো জন শিক্ষার্থী পাঠাব, আপনারা তাদেরকে ভাষা শিখাবেন । তারা বলল, আমরা তাদের জন্য ভিন্ন ব্যবস্থা করব এবং আমাদের খরচে তাদের পড়ালেখার ব্যবস্থা করব । এমনকি তাদের জন্য সংক্ষিপ্ত নেসাবও প্রণয়ন করব যাতে অল্প সময়ে ভাষাগত দক্ষতা অর্জন হয় । তাদের সাথে আমাদের এ মর্মে চুক্তি হয় কিন্ত আফগানিস্তানে যুদ্ধ শুরু হওয়ায় সব পরিকল্পনা ভেস্তে যায় ।
তো বলছিলাম, মাদরাসায় যোগ্য ছাত্র তৈরী হচ্ছে সত্য কিন্ত যোগ্যতার মান যদি হ্রাস পায় তার কী চিকিৎসা? চিন্তা দৈন্যতার কোন চিকিৎসা নেই । মাদরাসায় বেশির ভাগ এমন ছাত্র আসে যাদের চেন্তা চেতনা অনুন্নত । আর উন্নত চিন্তাশীল ছাত্র হাজারে দু’ একজন আসে । তবে উন্নত চিন্তাশীল যারা মাদরাসায় পড়তে আসে উন্নত হয়েই বের হয় ।
হাদীসে বর্ণিত হয়েছে, রাসূল [সাল্লাল্লালাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম] বলেন, যারা জাহেলিযুগে শ্রেষ্ঠ ছিল তারা ইসলাম গ্রহণের পরও শ্রেষ্ঠ । যারা পূর্বে অনুন্নত চিন্তা চেতনার অধিকারি ছিল তারা ইসলাম গ্রহণের পরও চিন্তার ক্ষেত্রে অনুন্নত থাকবে । দ্বীন সবার মধ্যে আসবে তবে উন্নত চিন্তা একটি প্রকৃতিগত বিষয় । মাদরাসার ক্ষেত্রে উপরোক্ত নীতি প্রযোজ্য । এখন মেহনত ছাড়া কোন বিকল্প নেই । ভয়-ভীতি, ওয়াজ-নসিহত দিয়ে কাজ হবে না । আপনি লাখো নসিহত করুন যে, ভাই ! তোমরা এসো । না আসলে এমন ব্যবস্থা গ্রহণ করব যে, বাধ্য হয়ে ইলমে দ্বীন শিখতে আসবে এবং দ্বীনি শিক্ষার প্রতি মনোযোগী হবে । যেমন ব্যবস্থা গ্রহণ করেছিল বাদশাহ আলমগীর ।
বাদশাহ আলমগরের শাসনামলের প্রথম দিকে সাধারণত উলামারা ছিল উপেক্ষিত । তাদের জিজ্ঞেস করার মতো কেউ ছিল না । সবার দৃষ্টি ছিল  মসনদ ও পদের দিকে । কেউ ইলমে দ্বীন অর্জন করত না । সবার প্রত্যাশা ছিল রাষ্ট্রীয় পদ এবং ক্ষমতায় সমাসীন হওয়া । এ প্রত্যাশা ছিল না কেবল উলামাদের । আলমগীর যেহেতু নিজেও আলেম ছিল তার অনুভূত হল । তিনি কোনো শাহী ফরমান জারি করলেন না । লিখলেন না কোনো উপদেশনামা । একদিন হুকুম দিলেন, আমি অযু করব । অমুক রাজ্যের শাসক আমাকে অযু করিয়ে দিবে । শাসক অযুর লোটা নিয়ে উপস্থিত হল । বাদশাহ আলমগীর জিজ্ঞেস করলেন, অযুর সুন্নাত কয়টি? ওয়াজিব কয়টি? তিনি কখনো অযু করলেই নাকি বলতে পারবে । আলমগীর বললেন, আজব ব্যাপার ? আপনি এত বিশাল রাজ্যের শাসক । এবং শাসন করছেন মুসলমানদেরকেও, অথচ আপনি অযুর ফরয কয়টি তা জানেন না? ব্যাস, বাদশাহ শুধু এটুকু বলেন ক্ষ্যান্ত হলেন ।....পরের দিন আদেশ করলেন, আজ অমুক আমীর আমার সাথে ইফতার করবে । আমীর বাদশাহর সাথে ইফতারে অংশ নিল । আওরঙ্গজেব জিজ্ঞেস করলেন, রোযা ভঙ্গের কারণ কয়টি? রোযার মধ্যে মাকরুহ কী কী? আমীর কিছুই বলতে পারল না । বাদশাহ বললেন, কত বড় আফসোসের কথা, মুসলমানদের শাসক হয়ে এসব প্রয়োজনীয় বিষষেয় জ্ঞান নেই? ....এভাবে একেক জনের কাছে একেকটি বিষয় জিজ্ঞেস করলেন । ফল এই দাঁড়াল, এখন মৌলবীদের খোঁজ শুরু হল । আমীর উমারাগণ উলামাদের কাছে মাসায়েল জিজ্ঞেস করতে শুরু করল । বাদশাহ জিজ্ঞেস করলে উত্তর দিতে না পারলে অপমানিত হতে হবে । কিন্ত কোনো মূল্যে উলামাদেরকে কাছে পাওয়া যায় না । আলেমরা নিজেদের অমুখাপেক্ষিতা প্রকাশ করতে লাগল । কোনো আলেম পাঁচ শ’র কম বেতনে রাজি হয় না । অনেকে হাজারের উপরে দাবী করে বসে । আমীর উমারাগণ বলল, ভাই ! মাসিক দুই হাজার দেব তবুও তোমরা এসো । সব উলামায়ে কেরাম ব্যস্ত হয়ে গেল । এজন্য ওয়াজ নসীহতে সব কিছু হয় না । ব্যবস্থাপনার ক্ষমতা আছে শাসকদের । কাজেই কখনো যদি সরকার মাদরসাশিক্ষার প্রতি সুদৃষ্টি বশত: এমন কোনো আইন প্রণয়ন করে যা তাদেরকে মাদরাসামুখি হতে বাধ্য করবে তবে তো ভালো । নয়লে শুধু ওয়াজ নসীহত দিয়ে পূর্ণ সুফল লাভ হবে না ।
@ হযরত ! মাদরাসা থেকে শিক্ষা সমাপন করে তালেবুল ইলমরা কর্মক্ষেত্রে বিভক্ত হয়ে পড়ে । কেউ দ্বীনি কাজে যুক্ত হয়, কেউ বৈষয়িক কাজে ব্যস্ত হয়ে পড়ে । যারা দ্বীনি কাজে যুক্ত হয় তারা দ্বীনি কাজে ভিন্ন ভিন্ন পন্থা অবলম্বন করে । এ সমস্যা থেকে উত্তরণে এমন কোনো পরিকল্পনা তৈরী করা যায় কিনা যার মাধ্যমে মাদরাসার ফারেগীন ছাত্ররা এক বিশেষ নিয়মের অধীনে ঐক্যবদ্ধ হয়ে কাজ করবে? বিভিন্ন প্রেক্ষাপটে সৃষ্ট সমস্যায় মাদরাসার পক্ষ থেকে সময়ে সময়ে তাদেরকে দিকনির্দেশনা দেওয়া হবে । মাদরাসা এবং আকাবিরদের থেকে তাদেরকে রাহনুমায়ী করা হবে । এর মাধ্যমে দ্বীনি কাজ সুশৃংখলভাবে আঞ্জাম পাবে । এর আরেকটি সুফল হল, ছাত্ররা তাদের ভবিষ্যত নিয়ে হতাশাগ্রস্ত হবে না । এক প্লাটফর্মে থাকলে পরস্পরকে সহযোগিতা করা সহজসাধ্য হবে । তাদেরকে মসজিদ মাদরসা এবং অন্যান্য কাজে যুক্ত করা যাবে । এ প্রস্তাবনার সম্পর্কে হযরতের মতামত কী?
@@ হাকীমুল ইসলাম : ......বাস্তব কথা এবং এমনটি হওয়া দরকার । কিন্ত তা কিভাবে করতে হবে? দুটি শক্তি যার মা্ধ্যমে সবাইকে এক কেন্দ্রীভুত করা সম্ভব । প্রথম শক্তি ক্ষমতা । হাতে ক্ষমতা থাকলে দেশব্যাপি কাউকে বিচ্ছিন্ন হওয়ার সুযোগ দিবে না । রাষ্ট্রীয় শক্তি থাকলে তা হবে জবরদস্তি ।
দ্বিতীয়ত, ইচ্ছা শক্তি । কারো প্রতি এতোই ভক্তি শ্রদ্ধা রয়েছে যে, সবাই তার ইশারা মত চলে । বর্তমানে আমাদের উভয় শক্তির মধ্যে রয়েছে দৈন্যতা । একটি তো আমাদের বিলকুল নেই । রাষ্ট্রীয় ক্ষমতা তো আপনাদের হাতে নেই । আছে কেবল শ্রদ্ধা ও ভালোবাসার শক্তি । কিন্ত তাতেও আজ খরা চলছে । অনেক শ্রদ্ধেয় ব্যক্তি রয়েছেন যাদের মাদরাসার সাথে সম্পর্ক নেই । ব্যক্তিগতভাবে মানুষ তাকে ভালোবাসে । এমন ব্যক্তি মাদরাসার চতুর্সীমায়ও আছে কিন্ত তাদের সংখ্যা হাতে গোণা । ....কাজেই কেন্দ্র থেকে বিচ্ছিন্ন হতে বিরত রাখে এমন শক্তি অর্জন হওয়া পর্যন্ত এ কাজ সম্ভব নয় । চাই তা বস্তুগত শক্তি হোক কিংবা ইন্দ্রীয় শক্তি।
আপনাদের ওখানে (পাকিস্তানে) ‘বেফাকুল মাদারিস’ নামে যে কাজ শুরু হয়েছিল তার অবস্থা কী?
@ বেফাক হল মাদরাসাসমূহের একটি কেন্দ্রীয় প্রতিষ্ঠান। আমার উদ্দেশ্য ছিল, প্রত্যেক মাদরাসা নিজেদের উপযোগী করে একটি নিয়ম করবে যে, উক্ত মাদরসার ফারেগীনরা উক্ত নিয়মের পাবন্দি করে মাদরাসার সাথে যুক্ত থাকবে।
@@ হাকীমুল ইসলাম : সকল মাদরাসাকে একই বিন্দুতে একীভূত করার চেয়ে তুলনামূলক এটি আরো সহজ। সকল মাদরাসাকে এক প্লাটফর্মে আনা কঠিন হলেও চেষ্টা করে দেখা যেতে পারে। চেষ্টা ছাড়া আমাদের আর কী বা করার আছে?
বিষয়টির প্রতি মনযোগ দিতে হবে এবং উপকারী ও কল্যাণকর দিকগুলো লিপিবদ্ধ করে তাদের সামনে পেশ করতে হবে। ছাত্রদের মাদরাসার সাথে যুক্ত রাখার ব্যবস্থা না থাকার ফলে  যেসকল ক্ষতি হচ্ছে তাও মাদরাসার দায়িত্বশীল ও এবং আকাবিরদেরকে দেখানো।...উদ্দেশ্য হল, আপনারা তাদের হিতাকাঙ্খি, প্রস্তাবের পেছনে ব্যক্তি স্বার্থ সংশ্লিষ্ট নেই যে, সব ছাত্র একটা বন্ধনে যুক্ত হলে আপনাদের সম্মান ও শক্তি বৃদ্ধি পাবে। এ বিষয়গুলো সামনে রেখে প্রস্তাব পেশ করা যথার্থ। তখন দায়িত্বশীল এবং অন্যদের দৃষ্টি আকর্ষণ করতে হবে। ...আজকাল একটা প্রথা হয়েগেছে, প্রথমে সাধারণ মানুষের দৃষ্টি আকর্ষণ করা হয় এটা ভুল পন্থা। বিশেষ ব্যক্তি সাধারণ যাদের হাতে রয়েছে তাদেরকে প্রথমে ‍দৃষ্টি আকর্ষণ করতে হবে। তখন জনগণ আপনাতেই চলে আসবে। কাজেই মাদরাসাসংশ্লিষ্ট এবং প্রভাবশালীদেরকে একত্রিত করে কার্যক্রম শুরু করতে হবে।
@...হযরত ! মাদরাসা সংশ্লিষ্ট কিছু বিষয় জেনেছি। এবার সাধারণ মুসলমানদের ব্যাপারে দু’একটি প্রশ্ন করতে চাই। সম্প্রতি পাকিস্তান জাতীয় সংসদে কাদিয়ানীদের ব্যাপারে বিল পাস করা হয়েছে। এ সম্পর্কে হযরতের মতামত ও বিশ্লেষণ কী?
@@...হাকীমুল ইসলাম : আমরা এ বিষয়ে আমাদের বক্তব্য তুলে ধরেছি। সেখানে পাকিস্তানের শাসক এবং উলামায়ে কেরাম উভয়কে সাধুবাদ জানানো হয়েছে । পাকিস্তানের জন্য এটা অনেক বড় সাহসী পদক্ষেপ। বাস্তব কথা হল, এ ছিল আমাদের বুযুর্গদের স্বপ্নের তা’বীর। হযরত মাওলানা আনওয়ার শাহ কাশ্মিরী, মাওলানা হাবীবুর রহমান সাহেব, মাওলানা মুর্তজা হাসান [রহ.] প্রমূখের স্বপ্ন ছিল যেভাবেই হোক এ বিভ্রান্তির অবসান হোক। কারণ কাদিয়ানীদের ইসলাম নাম ধারণ করে নিজেদের মতবাদ প্রচার করা এটা একটা বিভ্রান্তি। ইংরেজদের শাসন চলছিল বিধায় তাদেরকে কিভাবে অমুসলিম ঘোষণা করা হবে? আল্লাহ তা’আলা আজ সে স্বপ্ন পূরণ করেছেন। ওদিকে মধ্যপ্রাচ্যের ১৩২ সংগঠন কাদিয়ানিদেরকে অমুসলিম ঘোষণা দিয়ে বলেছে, তারা আমাদের দেশে প্রবেশ করতেই পারবে না। এদিকে পাকিস্তানে তাদেরকে অমুলিম ঘোষণা করে বিল পাশ করায় বিষয়টি আন্তর্জাতিক ইস্যুতে রূপ নিয়েছে। এর ফলে একটি আন্তর্জাতিক বিভ্রান্তির অবসান হল। দুনিয়াতে হাজারো বাতিল দল সৃষ্টি হয়েছে কিন্ত একমাত্র কাদিয়ানী ছাড়া অন্য কেউ মুসলিম নাম ধারণ নিজেদের কার্যক্রম পরিচালনা করেনি। তাই পাকিস্তান জাতীয় সংসদের পাশকৃত বিলের সমর্থনে আমি বক্তব্য দিয়েছি। অতঃপর কোলকাতাসহ বিভিন্ন জায়গা থেকে পত্র আসে। তারা জানিয়েছে, উক্ত বক্তব্যের প্রতিক্রিয়া এই হয়েছে যে, অনেক জায়গার মুসলিমরা ঘোষণা করেছে কাদিয়ানীদেরকে আমাদের কবরস্থানে দাফন করতে দেবনা। কবরস্থানগুলো যেহেতু সরকারের নিয়ন্ত্রণাধীন; তাদেরকে তো আমরা রুখতে পারব না। কাজেই মুসলমানদের মাঝে অনুভূতি জাগ্রত হয়েছে যে, আমরা প্রয়োজনে সরকারের বিরুদ্ধে লড়াই করব। আমরা সরকারের কাছে আমাদের দাবী পেশ করব এবং এ মর্মে ফাতাওয়া দেখাব যে, কবরস্থান পৃথক করে দেন। তাদের অংশ ভিন্ন আমাদের অংশ ভিন্ন। আমাদের অংশে তাদের কাউকে দাফন হতে দেব না।
এ রকম আরো অনেক বিষয় সামনে এসেছে। যেমন : ইতোপূর্বে কাদিয়ানিরা মুসলমানদের মসজিদে আসত। এ ঘোষণার কারণে তাদের মুসলমানদের মসজিদে আসা বন্ধ হয়েছে। ফলে প্রায় শতাধিক কাদিয়ানী তাওবা করে মুসলমান হয়েছে।
অনেকে আমাকে পত্রে জানিয়েছে, আমরা একটি সংস্থা প্রতিষ্ঠা করতে চাই। যার মাধ্যমে যে সকল কাদিয়ানী ইসলামের দিকে ফিরতে চায় তাদের বুদ্ধিবৃত্তিক সংশয়গুলো দূর করা হবে। আমি তাদেরকে লিখেছি, এমন সংস্থা অবশ্যই প্রতিষ্ঠা করুন। তবে কখনো ভরা মজলিসে সংশয় দূরকারক কোনো আলোচনার বিলকুল ব্যবস্থা করবেন না। এতে করে আরো বিভ্রান্তি ছড়াবে। কাদিয়ানিরা চায় ভরা মজলিসে তাদের সংশয়গুলো তুলে ধরলে কথার পিঠে কথা এবং বহাস বিতর্কের মাধ্যমে তাদের দাঁড়ানোর সুযোগ তৈরী হবে। হ্যাঁ, ব্যক্তিগতভাবে সংশয় উত্থাপন করতে পারেন কিন্ত সাধারণ মজলিসে সংশয় উত্থাপনের ব্যবস্থা বিলকুল করা যাবে না। তারা আমার কথা মত কাজ করেছে।
সারকথা, কাদিয়ানিদেরকে অমুসলিম ঘোষণা করে পাকিস্তান জাতীয় সংসদে আইন পাশ হওয়াতে ভারতীয় উপমহাদেশে অনেক ভালো প্রভাব পড়েছে।
[সাক্ষাৎকার গ্রহণ : মদীনা মুনাওয়ারা : ১৯৭৪ ঈসায়ী]
অনুবাদ সমাপ্ত : ১৮ জমাদিউল আওয়াল ১৪৩৯ হিজরী
৫ই ফেব্রুয়ারী ২০১৮ ঈসায়ী
২৩ মাঘ ১৪২৪ বঙ্গাব্দ
রাত : ১০:৩৬ মিনিট
সোমবার
স্থান : মতিন মোল্লার বাসা
মুরাদপুর, ঢাকা-১২০৪






[1] পৃষ্ঠা 74
[2] আমার মনে আছে, হযরত হাকীমুল ইসলাম কারী তৈয়্যব সাহেব [রহিমাহুল্লাহ] উক্ত মজলিস কিংবা অন্য কোনো বৈঠকে এটাও বলেছিলেন যে, ইলম তো নূর তথা আলো । আর আলোর কাজ ভালো মন্দ সৃষ্টি করা নয় বরং তার কাজ হল, ভালো মন্দ স্পষ্ট করে দেওয়া । যেমন, কোনো কক্ষে আলো না থাকলে কিচুই দৃষ্টিগোচর হয় না । কিন্ত ঘরে আলো জ্বালিয়ে দিলে ভালো মন্দ যেখানে যা রাখা আছে সবই স্পষ্ট দৃষ্টির সামনে উদ্ভাসিত হয়ে ওঠে । তদ্রূপ ইলমের আলো মানুষের আভ্যন্তরিণ ভালো মন্দ গুণাবলী সবার সামনে উন্মোচিত করে ।

No comments

Powered by Blogger.