অনুপম বদান্যতা : মাওলানা কালিম সিদ্দিকী
অনুপম বদান্যতা
লেখক : মাওলানা কালিম সিদ্দিকী
‘ভাই, আমাকে সামান্য মধু দিবেন? আমি একটি জটিল রোগে
আক্রামত্ম, চিকিৎসার জন্য কিছু মধু প্রয়োজন।’
‘দুঃখিত, এ মুহূর্তে আমার কাছে কোনো মধু নেই, তবে
সন্ধান দিতে পারি। কষ্ট করে একটু দূরে
যেতে হবে। ‘শাম’ থেকে এক বিরাট বাণিজ্য কাফেলা আসছে। সওদাগর খুব বড় মনের মানুষ।
আমার বিশ্বাস, আপনাকে তিনি নিরাশ করবেন না।’
কৃতজ্ঞতা জানিয়ে ‘হাজতমান্দ’ লোকটি শহরের বাইরে গেল।
কাফেলা শহরের উপকণ্ঠে পৌঁছলে সওদাগরের নিকট প্রয়োজন পেশ করবে।
দীর্ঘ প্রতীক্ষার পর কাফেলা দৃষ্টিগোচর হল। কালক্ষেপন
না করে তিনি একজনকে জিজ্ঞেস করলেন, কাফেলার সরদার কে? লোকেরা সুদর্শন জ্যোতির্ময় অবয়বধারি
এক ব্যক্তিকে দেখিয়ে দিল। ‘হাজতমান্দ’ কাফেলাসর্দারের কাছে গিয়ে আরজি পেশ করল :
জনাব! আমি এক জটিল রোগে আক্রামত্ম। চিকিৎসার জন্য কিছু মধু প্রয়োজন, তাই অনেক আশা
নিয়ে আপনার কাছে এসেছি।
‘উটের পিঠে দু’ মটকা মধু আছে, এক মটকা তাকে দিয়ে
দাও।’ সওদাগর গোলামকে আদেশ দিলেন।
‘মনিব! তাকে পূর্ণ এক মটকা দিয়ে দিলে উটের পিঠে
ওজনে ভারসাম্য থাকবে না।’
‘তবে দু’ মটকাই দিয়ে দাও।’
‘মনিব! দু’ মটকা মধু তার একার পক্ষে বহন করা
সম্ভব নয়’
‘তবে উটসহই তাকে দিয়ে দাও।’
গোলাম আর দেরি করল না। বিদ্যুৎগতিতে প্রস্থান
করল। দু’ মটকা মধুবোঝাই উট তার হাওলা করে ফিরে এলো।
লোকটি বিস্ময়ে হতবাক। হৃদয় নিঙড়ে মনের আবেগ ঢেলে
সর্দারকে দুআ দিলেন। ভেবে পাচ্ছিলেন না মানুষ এমন উদার হতে পারে। এ দেখি সাক্ষাত
হাতেম তাঈ। কী অনুপম বদান্যতা তার। সামান্য মধুর প্রয়োজন ব্যক্ত করলাম আর তিনি
কিনা আমাকে দিব্যি দু’ মটকা মধু বোঝাই উট দিয়ে দিলেন!
গোলামের আচরণে সর্দারের মনে বেশ কৌতূহল জেগেছে।
জিজ্ঞেস করলেন : এক মটকা মধু দিতে বললাম তুমি ওজর পেশ করলে। দ্বিতীয় মটকাও দিয়ে
দিতে বললাম তখনও তোমাকে তৎপর দেখিনি। কিন্তু দু’ মটকা মধু বোঝায় উট দিতে বলামাত্রই
তোমাকে খুব তৎপরতা দেখেছি। কারণ কী?
‘‘মনিব! আমি প্রথমে ওজর দেখিয়েছিলাম, কারণ এক
মটকা মধু তাকে দিয়ে দিলে উটের বোঝাতে ভারসাম্য থাকবে না। তখন আপনি দ্বিতীয় মটকাও
দিয়ে দিতে বললেন। আমি দেখলাম, তার একার
পক্ষে দু’ মটকা মধু বহন করা সম্ভব নয়। অতএব, আপনি তাকে উটসহ দুই মটকা মধু দিয়ে
দিলেন। আমি ভয় পেলাম। ভাবলাম, আর কোনো ওজর দেখালে মনিব হয়তো আমাকেও তার সাথে যেতে
বলবেন। এজন্য আমি দৌঁড় দিয়েছিলাম।’’
‘‘তার সাথে চলে গেলেই তো ভালো ছিল। দাসত্ব থেকে
মুক্তি পেতে?’’
গোলামের চোখ অশ্রম্নতে ভরে উঠল। আবেগ সংবরণ করতে
পারল না। বলল: মনিব! আমি এমন স্বাধীনতা চাই না যে স্বাধীনতা আমাকে আপনার থেকে
বিচ্ছিন্ন করবে। আপনি হয়তো আমার মতো হাজারো গোলাম পাবেন কিন্তু আপনার মতো মহৎ মনিব
আমি কোথায় খুঁজে পাব? গোলামী থেকে মুক্তির চেয়ে আপনার মতো মনিবের দাসত্বই আমার
কাছে বেশি প্রিয়। আপনার বিচ্ছেদ আমি সইতে পারবো না।
পাঠক! বলতে পারেন, কে ছিল অনুপম বদান্যতার অধিকারী এ মহান
মানুষটি?
বিশ্বনবী মুহাম্মাদ [সাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম]
এর প্রিয়তম সাহাবী, ‘যিননূরাইন’ খ্যাত, খোলাফায়ে রাশেদিনের অন্যতম হযরত উসমান ইবনে
আফফান [রাদিয়াল্লাহু আনহু] ছিলেন আলোচ্য গল্পের নায়ক।
প্রিয় পাঠক!
পৃথিবীর সৌভাগ্য যে, এমন সময়ও সে দেখেছে যখন
মুসলিমদের জীবন ছিল আল কুরআনের প্রতিচ্ছবি। তাদের আখলাক-চরিত্র, আচার-ব্যবহার এবং
লেনদেন ছিল মুহাম্মাদ [সাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম] এর আদর্শের জীবন্ত উপমা। ছিলেন
মানবতাবোধ ও সহানুভূতির মূর্ত প্রতীক। তাদের দয়া ভালোবাসা বদান্যতা ও বিশ্বাসযোগ্যতার
উপর প্রাণীকুলেরও ছিল পূর্ণ আস্থা। কুলমাখলুক জানত, ‘রহমাতুল্লিল আলামীন’ মুহাম্মাদ
[সাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম] এর অনুচর সৃষ্টিকুলকেও মুসলিমরা ‘আল্লাহ তা’আলার পরিবার’
জ্ঞান করে তাদের উপর দয়া করেন।
মহাবিশ্বের মহান স্রষ্টা আল্লাহ তা’আলা চির শান্তির
সংবিধান আল কুরআনে তারকাতুল্য এ সকল মহামানবদেরকে বিশেষ মর্যাদায় ভূষিত করেছেন।
ঘোষণা করেছেন-
فإن آمنوا بمثل
ما آمنتم به فقد اهتدوا
‘মানুষ তোমাদের অনুরূপ ঈমান আনয়ন করলে অবশ্যই সুপথের
দিশা পাবে।’
সাহাবায়ে
কেরাম রাসূল [সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম] এর কথা সচক্ষে দেখা বস্তু থেকেও
বেশি বিশ্বাস করতেন। সত্য জানতেন। আর এজন্যই তারা দুনিয়াকে ক্ষণস্থায়ী, ছেলেখেলার
জায়গা জ্ঞান করতেন এবং আখেরাতকে اللهم لا عيش
إلا عيش الأخرة প্রকৃত জীবন ও বাসস্থান বিশ্বাস করতেন। আল্লাহর পথে
ব্যয়িত সকল চেষ্টা প্রচেষ্টা ও অর্থ সম্পদই ছিল তাদের ধারনায় একমাত্র প্রকৃত
পুঁজি। আল্লাহর জন্য কোনো কল্যাণকর খাত কিংবা প্রয়োজনগ্রসত্ম মানুষের পেছনে ব্যয়
করে و كان الله شاكرا عليما এবং إن الله لا يضيع أجر المحسنين এর মতো গুণধারী অমুখাপেক্ষী স্বপ্রশংসিত প্রতিপালকের
ব্যাংকে জমা রাখতেন।
একটা সময় ছিল যখন মানুষ হাজারো স্বাধীনতাকামী এবং
রাজা বাদশাহদের উপর ‘সত্যের মাপকাঠি’ এবং ‘ঈমানের প্রতীক’ সাহাবায়ে কেরামকে
প্রাধান্য দিতেন। কিন্তু আজ...নবীয়ে রহমত [সাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম] এর
উম্মতের দাবিদার আমরা মুসলিমরা নিজেদের ব্যক্তিস্বার্থ বর্জন, দুনিয়ার প্রতি অনাসক্তি
এবং আখেরাতকে প্রকৃত জীবন বিশ্বাস না করার দরুন আজও আমরা দাসেত্বের শৃংখলে আবদ্ধ।
আমাদের অপরাধপ্রবণতা, প্রতিবেশীর সাথে অসদাচারণ, অধিকার হরণ এবং আদর্শবিবর্জিত
পরিবেশে অমুসলিমরা আজ মুসলমানদের সাথে বসবাস করতেও অপছন্দ করে। জানি না কবে আমাদের
বোধোদয় হবে।
ভাষান্তর :
আবু শাহামা মুহাম্মাদ হাবীবুল্লাহ মিসবাহ
জুরাইন, ঢাকা-১২০৪
জুরাইন, ঢাকা-১২০৪


No comments